Saturday, 4 September 2010

ইতিহাস থেকে কি আমরা কোনো শিক্ষাই নেবো না -১

বাংলাদেশের ইতিহাস খুব একটা পুরনো নয়, আজ থেকে ৩৯ বছর আগে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা লাভ করেছি স্বাধীনতার স্বাদ। স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থের গভীরতা অনেক, তবে সাধারনভাবে আমরা স্বাধীনতা বলতে কোন রাষ্ট্রের সাবভৌমত্ব ও অখন্ডতাকেই বুঝি। স্বাধীন রাষ্ট্রের সরকারের কিছু দায়িত্ব, কর্তব্য ও ভূমিকা থাকে। কর্তব্যগুলোর অন্যতম একটি হচ্ছে রাষ্ট্রের নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান করা। এই নিরাপত্তা শুধু অভ্যন্তরীন বিছৃংখলাকারীদের হাত থেকেই নয়, বর্হিঃবিশ্বের শত্রুদের হাত থেকেও। তবে গত ১৯ মাসে আমাদের সীমান্তের ঘটনাবলী আমাদেরকে নিরাপত্তার ব্যপারে শঙ্কিত করে তুলেছে। গত ১৯ মাসে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে মৃত্যু বরণকারী বাংলাদেশী নাগরিকের সংখ্যা ১৫০ ছারিয়ে গেছে। গত মাসে প্রায় ২৪ বাংলাদেশীকে অপহরণ করে বিএসএফ। কিছুদিন আগে সীমান্তে এক বাংলাদেশী নাগরিককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। বিএসএফ এর সাথে যতবারই পতাকা বৈঠক হয়েছে, সবদা একটি কথাই শোনা গেছে যে ঘটনাটি জনৈক উছৃঙ্খল সিপাহীর কাজ এবং এটির জন্যে তারা দুঃখ প্রকাশ করছে। এছাড়া বৈঠকে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটার আশ্বাসও দেয়া হয়ে থাকে। সমস্যাজর্জরিত বাংলাদেশ সরকারের জন্য এক নতুন সমস্যার নাম এই বিএসএফ।
তবে সরকার এই সমস্যাটিকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে বলে মনে হয় না, কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার কথা শোনা যায় নি। দিল্লী ঘোষণাপত্রে অনেক বিষয়ের কথা উল্লেখ থাকলেও, বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতীয়দের তান্ডবের ব্যপারে কিছু বলা হয় নি।
তবে সীমান্ত নিয়ে সমস্যা ভারতের জন্যে নতুন নয়। ব্রিটিশরা ভারত-পাকিস্তান-চীন এর সীমান্ত চিহ্নিত করে বিদায় নিয়েছে প্রায় ৭০ বছর আগে। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যবতী সীমান্ত চিহ্নিত করেন স্যার সাইরিল র‌্যাডক্লিফ ১৯৪৭ সালে, তার নামেই এই দু'দেশের মধ্যকার সীমান্তের নাম হয় র‌্যাডক্লিফ লাইন। আর ভারত এবং চীনের মধ্যবতী সীমান্ত চিহ্নিত করেন স্যার হেনরি ম্যাকম্যাহান ১৯১৪ সালে সিমলা অ্যর্কড অনুসারে, তার নামানুসারে এই সীমান্তের নাম রাখা হয় ম্যাকম্যাহান লাইন। তবে এই উভয় সীমান্তের কিছু অংশ নিয়ে বিরোধ তখনো ছিল, এখনো আছে। এছাড়া কাশ্মীর, হায়াদ্রাবাদ এবং নেপালের মতো স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ গুলো নিয়েও পরবতীতে বিভিন্ন সংকট সৃষ্টি হয়।
সাম্রাজ্যবাদী ভারত কখনই সীমান্তের প্রতি যথেষ্ট স্রদ্ধা প্রদশন করেনি। ১৯৪৭ সালে ভারত তাদের সাম্রাজ্যবাদের অংশ হিসেবে কাশ্মীরে সামরিক অভিযান পরিচিলনা করে এবং কাশ্মীরের প্রায় ৬০% এলাকা দখলে নিয়ে নেয়, পরবর্তীতে পাকিস্তানের হস্তক্ষেপের কারণে সমগ্র কাশ্মীর দখলে নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। বতমানে কাশ্মীর ৩ ভাগে বিভক্ত। এর এক অংশ ভারত, একটি অংশ পাকিস্তান এবং কিছু অংশ চীনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এছাড়া হায়াদ্রাবাদে ভারত ১৯৪৮ সালে সামরিক অভিযান "অপারেশন পোলো" পরিচিলনা করে, এবং জোরপূর্বক হায়াদ্রাবাদের দখল নেয়। যদিও হায়াদ্রাবাদের নিযাম স্বাধীন হায়াদ্রাবাদের পক্ষে ছিলেন এবং ভারতের সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে তিনি তার অথমন্ত্রীকে ৫০,০০০ রাইফেল কিনতে ব্রিটেনে প্রেরণ করেন।
পরবতীতে ১৯৬৫ সালের এপ্রিলে ভারত গুজরাট সীমান্তের রান-অফ-ক্বচ নিয়ে পাকিস্তানের সাথে আবারও যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৯৯৮ সালে কারগিল সীমান্তে ভারত-পাকিস্তান আরেকটি সংঘাত সংঘটিত হয়।
হিমালয় সীমান্তে ১৯৬২ সালে চীন ও ভারতের মধ্যে আক্সাই-চিন যুদ্ধ বাধে। যুদ্ধের কারণ ছিল এই যে, ১৯৫৩ সাল থেকে ভারত তার সীমান্তকে ম্যাকম্যাহন লাইন পযন্ত বিস্তৃত করার প্রচেষ্টা চালায় । এখানে উল্লেখ্য এই যে, ব্রিটিশদের দ্বারা চিহ্নিত এই সীমান্ত চীন কখনোই সম্পূনরূপে স্বীকার করেনি, এছাড়া এই সীমান্ত রেখার ফলে চীনের কিছু প্রদেশের অংশবিশেষ ভারতের সীমান্তে পড়ে। চীনের সাথে তিব্বত নিয়ে বিরোধ হওয়ার পর থেকে ভারত ও চীনের মধ্যে একাধিকবার সীমান্ত সংঘর্ষ হয়। আসাম সীমান্তে চীনের সেনাবাহিনী ও বিএসএফ এর মধ্যে এখনো অনেক সীমান্ত সংঘষের কথা শোনা যায়। উল্লেখ্য, চীন বহু আগে থেকেই আসামের কিছু অংশে তাদের অধিকার দাবি করে আসছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে জওহরলাল নেহেরু ভুটান ও সিকিমকে ভারতের সংরক্ষিত প্রদেশ হিসেবে প্রচার করেন। পরবতীতে ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে সিকিমকে ভারত নিজের রাজ্যে পরিণত করে।
১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সাহায্য করে এবং পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ৩রা ডিসেম্বর প্রত্যক্ষভাবে ভারত এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অজিত হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নতুন মেরুকরণ। বাংলাদেশ সরকার ভারতের সাথে সীমান্ত সমস্যা সমাধানে চুক্তি সম্পাদন করে। বঙ্গবন্ধুর একান্ত চেষ্টা ছিল এই সীমান্ত সমস্যার স্থায়ী সমাধান সাধনে। তার শাসনামলে পাশ করা বাংলাদেশের সংবিধানের ৩য় সংশোধনীর উদ্দেশ্যই ছিল ভারতের সাথে সীমান্ত সমস্যার সমাধান। এর ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তের ১৫ টি স্থানে রদবদল হয়। বাংলাদেশ এই চুক্তি মোতাবেক ভারতকে সীমান্তবতী এলাকা গুলো হস্তান্তর করলেও ভারত এখনো ঐ সকল এলাকা আমাদের হস্তান্তর করেনি। তদুপরি, ১৯৯৫ সালের দিকে বাংলাদেশ ও ভারতের বিরোধপূর্ণ নৌ-সীমায় দক্ষিন তালপট্টি নামের একটি দ্বীপ সৃষ্টি হলে, কোনো ধরনের আলোচনার সু্যোগ না দিয়েই ভারত তা দখল করে নেয়। এছাড়াও শান্তিচুক্তির পূর্বে পার্বত্য অঞ্চলে সৃষ্ট সমস্যার জন্যেও ভারতকে দায়ী করা হয়।
দক্ষিন এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যকার বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত যুদ্ধগুলোকে পর্যবেক্ষন করলে আমরা দেখতে পাই, প্রতিটি যুদ্ধেই ভারত অংশগ্রহণ করেছিল। প্রতিটি যুদ্ধেই একটি পক্ষ ছিল ভারত। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যুদ্ধংদেহী মনভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো। দক্ষিন এশিয়ার ইতিহাসের দিকে তাকালেই যা সহজেই অনুধাবন করা যায় তা হলো ভারতের অব্যহত সাম্রাজ্যবাদ, যা কালে কালে এই অঞ্চলকে অশান্ত করে রেখেছে। আর এই সাম্রাজ্যবাদী নীতি কখোনোই কোনো আধাসামরিক বা সামরিক বাহিনীর সিপাহীদের পক্ষে নেয়া সম্ভব নয়। তাই স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে, বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয়দের অপতৎপরতা, হামলা কিংবা অপহরণ নিছক কিছু উছৃংখল সিপাহীর দ্বারা সঙ্ঘটিত ঘটনা নয় বরং ভারতীয় সরকারের সম্মতিতে তাদের সাম্রাজ্যবাদের বহিঃপ্রকাশ।
চীন এবং পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতা, সরকারগুলোর তৎপরতা এবং শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতির কারণে গত বছরগুলোতে ভারতীয় সীমান্তে সংঘষের হার এবং সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব হ্রাস পেয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশের সামরিক দুবলতা, সরকারের এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ঔদাসীন্যের কারণে বাংলাদেশের উপর ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের কালো থাবা পড়তে শুরু করেছে।
তাই একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সরকারের প্রতি আমার একান্ত অনুরোধ, ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ এবং অপতৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন, কার্যকরী ব্যবস্থা নিন এবং দেশকে তাবেদার রাষ্ট্র হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করুন।

1 comment: