১৮ মার্চ সম্ভবত শহীদ মিনার থেকে মিছিল করে আমরা বঙ্গভবনে
পৌঁছলাম দুপুরবেলা। ডায়েরিতে টুকে রাখিনি বলে সময়টা মনে নেই। সে মিছিলে ঢাকাস্থ
সকল বুদ্ধিজীবী পরিবার ও সদস্যরা অংশগ্রহণ করেছে। বঙ্গভবনের গেইটে আমাদের মিছিলটা
যখন পৌঁছাল-- আমরা বাধা পেলাম।
ভেতরে ঢোকার অনুমতি পেলাম না। কিন্তু আমাদের জেদ, আমরা ভেতরে যাব এবং ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করবই। ইন্দিরা
গান্ধী একজন মহিলা, তিনি মা-বোনের মর্মব্যাথা
বুঝবেন। বাংলাদেশের কত মা-বোন স্বামী-পুত্র-ভাই হারিয়ে চোখের জল ফেলছে, সে-কথা তাঁকে আমরা শোনাতে চেয়েছি। যুদ্ধবন্দী ও হত্যাকারীরা যেন
কোনমতে বিনা বিচারে মুক্তি না পায়, সে-আবেদন তাঁকে জানাতে
চেয়েছি। কিন্তু ভেতরে যাওয়ার অনুমতি আমরা কিছুতেই পেলাম না। কর্তব্যরত অফিসার
ভেতরে বঙ্গবন্ধুর সাথে যোগাযোগ করলেন, ভেতর থেকে নির্দেশ এল আমাদের
যা বলার গেইটেই যেন বলে যাই। আমাদের দাবি বিবেচিত হবে। কিন্তু সে-কথা মানতে আমরা
রাজি নই। মাথার উপর প্রচণ্ড রোদ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়ল।
আমরা সবাই রাস্তায় বসে পড়লাম। অপেক্ষা করছি ইন্দিরা গান্ধী এ পথ দিয়ে যখন যাবেন তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করব।
আমাদের জেদ দেখে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু চলে এলেন গেইটে আমাদের কাছে। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি, কালো মুজিব-কোট পরিহিত বিশাল ব্যাক্তিত্ব আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে মৃদু কান্নার রোল পড়ে গেল। তিনি সামনে এগিয়ে আসতেই নাফিসা কবিরও একটু এগিয়ে গেল। নাফিসা কবির সে-মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিল। আমাদের হয়ে নাফিসা কবিরই কথা বলার জন্যে সামনে এগিয়ে গেল।
বঙ্গবন্ধু বলে উঠলেন- 'আপনারা কি বলতে এসেছেন? বিদেশী মেহমান, তাঁর কাছে এভাবে মিছিল করে যাওয়াটা কি আমাদের জন্যে সম্মানজনক হবে? আপনাদের যা বলার আমাকেই বলুন।'
নাফিসা কবির (বড়দি) পরিষদের দাবী-দাওয়াগুলো বলতেই বঙ্গবন্ধু
বলে উঠলেন, 'অনেকে ত দালালী করে মরেছে।'
সঙ্গে সঙ্গে বড়দি একটু উত্তেজিত হয়ে বলল,- 'বঙ্গবন্ধু, আপনি ত এদেশের কিংবদন্তী নেতা। ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতার। স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। আপনি আটক ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। বুদ্ধিজীবীরা কেউ দালালী করে মরেনি। দালালী যারা করেছে, তারা এখনও বেঁচে আছে। সে-দালালদের বিচারের দাবী জানাতে এসেছি।'
সঙ্গে সঙ্গে বড়দি একটু উত্তেজিত হয়ে বলল,- 'বঙ্গবন্ধু, আপনি ত এদেশের কিংবদন্তী নেতা। ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতার। স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। আপনি আটক ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। বুদ্ধিজীবীরা কেউ দালালী করে মরেনি। দালালী যারা করেছে, তারা এখনও বেঁচে আছে। সে-দালালদের বিচারের দাবী জানাতে এসেছি।'
'দালালদের বিচার করব। সে-কথা আমি বহুবার বলেছি। এভাবে মিছিল করে আসার কি অর্থ আছে! বিদেশী মেহমানের কাছে কি তাতে সম্মান বাড়বে?'
বঙ্গবন্ধু বিদেশী মেহমান নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন; স্বভাবতই উনি একটু উত্তেজিত ছিলেন সে-মুহূর্তে।
কিন্ত বড়দি আরো বলল- 'ইন্দিরা গান্ধী একজন মা, মা-বোনদের বেদনাটা উনি হয় বুঝতে পারবেন। আপনি ত কাউকেই হারাননি, আমাদের দুঃখটা আপনাকে বোঝাতে পারবো না।'
- পান্না কায়সার ( মুক্তিযুদ্ধঃ আগে ও পরে)
No comments:
Post a Comment