গত ৬ মার্চ একটি প্রতিবেদনে চোখ আটকে গেল। জামায়াতের সাথে আওয়ামীলীগের আঁতাতের অভ্যস্ততার কারনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব নয়, বলেছেন প্রখ্যাত রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং গবেষক বদরুদ্দীন উমর।
এই "নব্য রাজাকার" ট্যাগিং-এর সময়ে তিনি এই কথাটা বলতে পেরেছেন তাই তাঁর সাহসের তারিফ করতেই হয়।
প্রবীণ বামনেতা এবং জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর সেইদিন বলেছেন,
এই "নব্য রাজাকার" ট্যাগিং-এর সময়ে তিনি এই কথাটা বলতে পেরেছেন তাই তাঁর সাহসের তারিফ করতেই হয়।
প্রবীণ বামনেতা এবং জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর সেইদিন বলেছেন,
জামায়াতের সাথে আওয়ামী লীগ আঁতাতে অভ্যস্ত সে কারণে আওয়ামী লীগের পক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের সুষ্ঠু বিচার সম্ভব নয়।
“১৯৭৩ সালে শেখ মুজিবুরের মতো এবার পাকিস্তানের সঙ্গে আঁতাত করেছেন শেখ হাসিনা । এ জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ট্রাইব্যুনাল ‘আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বদরুদ্দীন উমর।
বুধবার বিকেলে পল্টনের মুক্তি ভবনে চারটি বামদলের ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, দেশব্যাপী জামায়াত-শিবিরের সহিংসতা, রাষ্ট্রীয় হত্যা-সন্ত্রাস ও জনগণের হাতে ক্ষমতার প্রশ্ন’শীর্ষক আলোচনা সভায় বদরুদ্দীন উমর এসব কথা বলেন।
বদরুদ্দীন উমর তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা করে বলেন, “শেখ মুজিব ১৯৭৩ সালে ‘বাঙালি ক্ষমা করতে জানে’ বলে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে চুমো দিয়ে ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করেছিলেন। তিনি সর্বনাশের যে শুরু করেছিলেন, এখন তা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।”
বদরুদ্দীন উমর আরো বলেন, “শেখ মুজিবের ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনা জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করে ১৯৮৬ সালে এরশাদের অধীনে নির্বাচন করেন। ১৯৯২ সালের জাহানারা ইমামের গণ-আদালতের রায়ের সঙ্গে বেঈমানি করে আওয়ামী লীগ ১৯৯৪ সালে জামায়াতের সঙ্গে একমঞ্চে আন্দোলন করে এবং ক্ষমতায় গিয়ে ১৯৯৬ সালে জামায়াতকে দুটি মহিলা আসন এনাম দেয়।”
শাহবাগের আন্দোলন নিয়ে বদরুদ্দীন উমর বলেন. “শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের জাগরণ ছিল সরকার-জামায়াত আঁতাতের বিরুদ্ধে ইতিবাচক গণ-আন্দোলন। পরে তা আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, দূর্বল ও সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। এখন এর মাধ্যমে গণবিচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগ ভোটের পাল্লা ভারী করতে চাইছে।”
বদরুদ্দীন উমর আরও বলেন,
শাহবাগের তরুণ প্রজন্মকে বুঝতে হবে, ৪২ বছর ধরে ঘুরে-ফিরে যারাই ক্ষমতায় এসেছে, তারা তাদের শ্রেণীস্বার্থে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেনি; আওয়ামী লীগও করবে না।
বদরুদ্দীন উমর কথা ইতিহাস সম্মত এবং শত ভাগ সত্য বলে মনে হয়েছে। অতীতেও গণবিচ্ছিন্ন আওয়ামীলীগ জনগণমনকে পক্ষে আনতে "যুদ্ধাপরাধী কার্ড" খেলেছে। এখনও খেলছে। এবং সম্ভবত তাঁরা চমৎকারভাবে সফল হয়েছে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, এই খেলার পর মূল খেলোয়াড়দের আওয়ামীলীগ পাশে সরিয়ে দিয়েছে।
এভাবেই আজ থেকে ২০-২২ বছর আগে প্রবল জনসমর্থন নিয়ে গঠিত হয়েছিল গণ আদালত। ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারী প্রতিষ্ঠিত একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এই গণ আদালত গঠন করে। এর সাথে যুক্ত হন অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব। বাঙলাদেশের প্রখ্যাত মুরতাদ আহমদ শরীফও ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
আহমদ শরীফ ছিলেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব যিনি নিঃসংকোচে কাউকে ভয় না করে সত্য কথা বলতে পারতেন। তাই তো শেখ মুজিবকে গণশত্রু, কিংবা জিয়াকে দুর্লভ অমানুষ বলতে তাঁর বাঁধেনি।
আহমেদ শরীফ তাঁর ডায়েরিতে এমন অনেক কথা তুলে ধরেছেন এই গণ আদালত আর আওয়ামীলীগের বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে। যা বদরুদ্দীন উমরের বক্তব্যকে সমর্থন করে।
পাঠকদের জন্যে তাই সেই অংশগুলো তারিখসহ তুলে দিচ্ছি,
(০৫/০৭/৯৪)
জাহানারা ইমামের লাশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ কবর দিচ্ছে রাজাকার-মৌলবাদী বিরোধী আন্দোলনকেও। আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও এরশাদের জাতীয় পার্টির সাথে আঁতাত করে বিএনপি বিতাড়নে মাঠে নেমেছে। অতএব রাজাকার গোলাম আজমের শাস্তির আন্দোলন এভাবেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। রাজাকার-মৌলবাদ বিরোধিতা এখন থেকে ঝিমিয়ে পড়বে, হবে শক্তিহীন।

(২৮/০১/৯৬)
রাজাকার-বিধ্বংসী আন্দোলনরাজাকারদের ৯১ সন অবধি সহ্য করা হয়েছে। শাহ আজিজরা দেশ-শাসন করেছে। জিয়া রাজাকার সহযোগিতায় নায়কতন্ত্র চালু করেছিলো। রাজাকার নায়ক গোলাম আজমকে জিয়া চৌদ্দ বছর পুষেছে। হঠাৎ জাহানারার নেতৃত্বে কিন্তু কর্নেল কাজী নুরুজ্জামানের উদ্যমে- উদ্যোগে- আয়োজনে গণআদালতি আন্দোলন গড়ে উঠলো, জোড়ালো হলো। তাদের দাবি ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীরুপে গোলাম আযমের বিচার।
সংসদের অধিবেশনকালে এ আন্দোলন মন্দা বা নিলুপ্ত করার অভিপ্রায়ে সরকারী দলের উপনেতা ডাক্তার বদরুদ্দোজা চৌধুরী ঘোষণা করলেন গোলাম আযম অবশ্যই অপরাধী এবং তার বিচার হবে আদালতে। জাহানারা ইমামের আন্দোলনে ট্রাইব্যুনাল মিললো না। সরকারও আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে কথা রাখলো না। জাহানারা ইমামরাও আদালতের আশ্রয় নিলেন না। মাঝখানে গোলাম আযমের সন্তানের আবেদনক্রমে সুপ্রীমকোর্ট গোলাম আযমকে বাঙলাদেশের নাগরিকরূপে স্বীকৃতি দিলো। তবু বিক্ষুব্ধ জনতা তাঁর প্রতি মারমুখো রইল।
ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে পুরো মেয়াদ অবধি রাজত্ব করতে না দেয়ার মতলবে তুচ্ছ অজুহাতে সংসদ বর্জন করলো, সঙ্গে নিলো স্বৈরাচারী বলে ধিক্কৃত ও বিতাড়িত এরশাদের জাতীয় পার্টিকে আর রাজাকার বলে ঘৃণিত জামায়াত-ই-ইসলামী দলকে। এভাবে আওয়ামী লীগ সুবিধাবাদী নীতি গ্রহন করে আত্মহননের ও ঘৃণ্য হওয়ার পথ বেছে নিলো। জনগণের সারল্যের ও অবজ্ঞার সুযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রচার করলো যে জাতীয় পার্টির ও জামায়াত-ই-ইসলামির সঙ্গে আঁতাত করেছে সংসদীয় সংগ্রামে সহযোগী ও সঙ্গীরূপে পাওয়ার জন্য-সাধারণ শত্রু বিএনপিকে গদীচ্যুত করবার লক্ষ্যে। তাই বলে জামায়াতকে কিংবা জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগ মিত্র ভাবে না, ভাবে না সহযোগী রূপে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
জনগণকে বিভ্রান্ত রাখার গরজে সৈয়দ হাসান ইমাম-শাহরিয়ার কবির প্রভৃতি সব আওয়ামীলীগার দিয়ে গঠন করিয়েছে নির্মূল ও সমন্বয় কমিটি। অর্থ আত্মসাৎ প্রভৃতি অভিযোগ ও দ্বন্দ্বে কমিটি দুইভাগ হয়েছে। এটা আর জমবে না আন্দোলন হিসেবে। আমি চরম ঘৃণায় তাদের সম্পর্ক ত্যাগ করেছি-গণআদালতী আসামী হয়েও।
আমি রাজাকারদের নিয়ে ঘাঁটঘাটি নিরর্থক ও অন্যায় বলেই মানি, কেননা এক রাষ্ট্রপতি তাদের ক্ষমা করেছেন, অন্য এক জঙ্গী নায়ক জিয়া তাঁদের তাঁর সহযোগী সম্বল করে রাজত্ব করেছিলেন। তখন কেউ আন্দোলন করেনি। সবাই উক্ত দুই শাসকের সিদ্ধান্তের বা নির্দেশের বিরুদ্ধে আন্দোলনে এগিয়ে আসেনি যথাসময়ে। আমার লক্ষ্য ছিলেন গোলাম আযম। কারণ আমার চোখে তিনি ব্যক্তি ছিলেন না, ছিলেন একজন একটি ইসলামিক দলের সর্বজনমান্য নেতা ও ব্যক্তিত্ব, একটা রাজনীতিক দলের, একটি আদর্শের, একটি লক্ষ্যের, একটি প্রতিষ্ঠানের, একটি রাজনীতিক ও শাস্ত্রিক শক্তির প্রতীক, প্রতিম ও প্রতিভু; তাই তার পতনে বা শাস্তিতে আমার ধারণা জামায়াতী ইসলামি দল হৃতবল, হীনবল হয়ে হয়ে আত্মবিলুপ্তি পেত।

(২৮/০৬/৯৮)জাহানারা ইমাম
জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ‘ঘাদানি’ কমিটিতে শাহরিয়ার কবিরের আকস্মিক আহ্বানে আমিও যোগ দিয়েছিলাম গণআদালত বসার পূর্বমুহূর্তে। আমার বিশ্বাস ছিল : যদি গোলাম আজমকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা যায়, কিংবা তাঁর শাস্তির ব্যবস্থা হয়, তাহলে নেতৃত্বের অভাবে জামায়াতে ইসলামী ক্রমে দুর্বল হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক অস্তিত্ব হারাবে।
কিন্তু গোলাম আজম নাগরিকত্ব পেলেন বিচারে, আর আওয়ামীলীগ দলীয় স্বার্থে তাঁকে দেশব্যাপী সভা করার সুযোগ দিয়ে ও শ্রোতা যোগাড়ে প্রত্যক্ষ সহায়তা দিয়ে আওয়ামীলীগারদের দিয়ে দেশে অন্যতম রাজনীতিক দলের নেতারূপে স্বীকৃতি ও স্থায়ী প্রতিষ্ঠা দিল।
তাঁর বিরুদ্ধে নরহত্যায় নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে, প্ররোচিত করার জন্যে, নীল নকশা তৈরি করে দেয়ার জন্যে আসামী করে মামলা রুজু করা যেত। আওয়ামী লীগের প্রভাবে পড়ে জাহানারা ইমাম কিংবা সৈয়দ হাসান ইমাম প্রমুখ এখনকার আওয়ামী লীগপন্থী ঘাদানি কমিটি তা করলেন না, তবে আওয়ামীলীগার হয়েও অকারণে [কেননা আওয়ামী লীগ নির্বাচন পূর্বকালে জামায়াতের মিত্র ছিল] ‘ঘাদানিরূপে’ সভা করে লোক-দেখানো [কারো কারো মতে অর্থাগম লক্ষ্যে] নিষ্ক্রিয় অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আজ জাহানারা দেশবন্দ্য মহীয়সী মহিলা। তাঁর স্মৃতি অমর ও অবিমোচ্য রাখার জন্যে হল-হোস্টেল-সড়ক হচ্ছে। বার্ষিক সভা হচ্ছে।
(আহমদ শরীফের ডায়েরিটি ভাব-বুদ্বুদ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়, সেখান থেকে আলোচ্য অংশটুকু নেয়া হয়েছে)
No comments:
Post a Comment