[‘বাংলাদেশ : দ্যা আনফিনিশড রেভ্যুলেশন’ বই এর লেখক লরেঞ্জ লিফশুলজ ১৯৭৯ সালের ১৫ অগাস্ট দ্যা গার্ডিয়ানে একটি চমৎকার প্রতিবেদন প্রকাশ করেন যা মুজিবের হত্যাকান্ডের অনেক বিষয় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে। প্রতিবেদনটির কিছু অংশ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এটি অনেক বিস্তারিতভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রকাশ করে যা ইতিহাসের যেকোন পাঠকের কাছে তাৎপর্য্যপূর্ণ একটি প্রতিবেদন হিসেবে কাজ করবে। এখানে এর কিছু অংশ বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হলো]
অনেক কাহিনীই বলা হয়ে থাকে এবং উঠে আসে বিভিন্ন প্রতিবেদনেও। অব্যহতভাবে একজন বিদেশী সাংবাদিক, যিনি প্রাথমিকভাবে এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিলেন পুরো ঘটনাটিকে খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলেন যা মাকড়সার জালের মতো বিস্তৃত ছিল একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আর বিস্বাসঘাতকতার দরুন। অভ্যুত্থান বা মধ্যরাতের নৃশংশতা যাই হোক না কেন, তার খুব ক্ষুদ্র অংশই প্রকাশিত হয়। আর যাই প্রকাশিত হোক না কেন, তা যথেষ্ট তথ্যসমৃদ্ধ হয় না এবং তা দ্বারা প্রকৃত ঘটনা অনুধাবন সম্ভবপর হয় না। খুব কম লেখকই পুনরায় ঐ ঘটনার কাছে ফিরে যান, আর পরে যা খুজে পান তা প্রকাশিত ঘটনা থেকে অনেকটাই ভিন্ন।
এমনঈ এক ঘটনা ঘটে আজ থেকে চার বছর আগে ১৪ অগাস্ট, ১৯৭৫ সালে যখন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান একটি সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন। গার্ডিয়ানের হয়ে মার্টিন উলাকট এবং আমি ঐ দিন যা ঘটেছিল এর উপর একটি অত্যন্ত বিস্তারিত লেখা প্রকাশ করি। এটি প্রধান শিরোনাম হিসেবে ২৩ অগাস্ট, ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত হয়। পেছনের দিকে তাকিয়ে আমাদের মনে হলো যে, আমরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যয় পেছনে ফেলে এসেছি। শুধুমাত্র এর কুশীলবেরা বাদে কেউই জানতে পারে নি প্রকৃতপক্ষে সেদিন কি ঘটেছিল।
অভ্যুত্থানটি বর্ষাকালের কোনো এক অসহ্যরকমের গরমের রাতে সংগঠিত হয়েছিল। পরেরদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ কি হতে পারে, তা-ই নিয়ে সেই রাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে চলছিল তুঁখোড় আলোচনা । বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছিল আর কোন গুপ্ত বাম্পন্থী সংগঠন ছাত্রলীগের সেই সভায় কিছু একটা করার চেষ্টা করতে পারে কিনা তা-ই ছিল জনগণের আগ্রহের কেন্দ্রে। এছাড়া সেই গ্রীষ্মের রাতটিতে তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছিল না।
ঠিক তখনই ঢাকার জীবনযাত্রায় এক অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। মধ্যরাতের কিছুপরেই বেঙ্গল ল্যান্সারস আর বাংলাদেশ আর্টিলারী ডিভিশনের সেনারা ঢাকার প্রধান ক্যান্টনমেন্ট থেকে ধীরগতিতে এগিয়ে যেতে শুরু করে শহরের পরিত্যাক্ত ও অর্ধনির্মিত দ্বিতীয় বিমানবন্দরের দিকে। পুরো বাহিনীটি একটি লাইনে মূল রানওয়ে দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। কর্ণেল ফারুক, যিনি একটি ট্যাঙ্কে চড়ে অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি স্পষ্টভাবে তার বাহিনীকে জানিয়ে দেন যে তারা মুজিবের এই শাসনকালের সমাপ্তি ডেকে আনতে রওয়ানা হয়েছে। কর্ণেল ফারুক এক অগ্নিঝরা বক্তব্য দেন যা তার বাহিনীকে অভিযানের জন্যে সম্পুর্নরূপে প্রস্তত করে তোলে। প্রায় সাথে সাথেই পুরো বাহিনীটি এগিয়ে যেতে থাকে তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে। মাত্র তিন ঘন্টায় তারা মুজিব এবং তাঁর পরিবারের অন্তত চল্লিশ সদস্যকে হত্যা করে।
প্রকৃতপক্ষে সেই রাতে যে অবস্থার উদ্ভব ঘটেছিল তা হচ্ছে এই যে, সেনাবিহিনীর ছয়জন কর্মকর্তা সম্পূর্ণ নিজস্ব সিদ্ধান্তে তাদের অধীনস্থ প্রায় তিন’শ সেনা নিয়ে শেখ মুজিবকে পৃথিবী ছাড়া করে। অভ্যুত্থানটি সম্ভবপর হওয়ার পেছনে কাজ করেছে মুজিব ও তাঁর সহযোগীদের প্রতি সেনাকর্মকর্তাদের মধ্যকার আক্রোশ এবং দেশব্যাপী মুজিবের শাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থা ও বিরুদ্ধভাবাপন্ন মনোভাব যার সৃষ্টি হয়েছিল দেশব্যাপী বিস্তৃত চরম দুর্নীতি আর অব্যাবস্থাপনার কারণে।
অভ্যুত্থানটির ব্যাপারে প্রতিবেদনের সময় কোন বাঙালী বা বিদেশী সাংবাদিক এর পেছনের সুগভীর অবয়বটি প্রকাশ করতে সক্ষম হননি। এই সেনাকর্মকর্তারা আঘাত হানার আগে কাদের সাথে গোপন যোগাযোগ রাখছিল, কাদেরকে এড়িয়ে গিয়েছিল এই প্রশ্নগুলো অমীমাংসিত রয়ে গিয়েছিল। আর হত্যার পুর্বে ও পরে ওই সেনাকর্মকর্তারা সম্পুর্ণ নিজস্ব সিদ্ধান্তেই সব কাজ করেছিল বিশেষ কোন রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা ছাড়াই, এমন একটি ধারণা সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল।
খন্দকার মোশতাক, যিনি মুজিবের আওয়ামীলীগের ডানপন্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে বিশেষ পরিচিত ছিলেন তাকেই তরুণ মেজররা বাংলাদেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিবেচনা করেছিল। মুজিবের মৃত্যুর পরপরই তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষনা করা হয়। অভ্যুত্থানের পর থেকেই মোশতাক মুজিবের পতনের সকল ব্যাপারেই নিখুঁতভাবে তাঁর গাম্ভীর্য বজায় রাখেন। তিনি কখনই এ ব্যাপারে তাঁর জড়িত থাকার কথা স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটিই করেননি। বরং তিনি সকল আলোচনা বা প্রশ্নোত্তর সভা এড়িয়ে যেতে থাকেন এবং তাঁর শাসন ব্যাবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে উঠেপড়ে লাগেন।
অভ্যুত্থানের পরের বছর খন্দকার মোশতাকের পতনের পর যখন দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, তাঁর পূর্বেই তিনি আমার কাছে অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী মেজরদের সাথে তাঁর কোন পূর্ব বৈঠকের কথা অস্বীকার করেন। কিন্তু যে কারণেই হোক এ ব্যাপারে মেজররা আমাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা শুনিয়ছিলো। (চলবে)
No comments:
Post a Comment