[‘বাংলাদেশ : দ্যা আনফিনিশড রেভ্যুলেশন’ বই এর লেখক লরেঞ্জ লিফশুলজ ১৯৭৯ সালের ১৫ অগাস্ট দ্যা গার্ডিয়ানে একটি চমৎকার প্রতিবেদন প্রকাশ করেন যা মুজিবের হত্যাকান্ডের অনেক বিষয় বিস্তারিতভাবে তুলে ধরে। প্রতিবেদনটির কিছু অংশ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এটি অনেক বিস্তারিতভাবে এমন কিছু ঘটনা প্রকাশ করে যা ইতিহাসের যেকোন পাঠকের কাছে তাৎপর্য্যপূর্ণ একটি প্রতিবেদন হিসেবে কাজ করবে। পূর্বে এর কিছু অংশ বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়েছিল, আজ প্রকাশ করা হলো এর দ্বিতীয় পর্ব]
সেনাকর্মকর্তারা খন্দকার মোশতাক এবং তাঁর সহযোগীদের সাথে তাদের পূর্ব সম্পর্ক এবং একাধিক আগাম বৈঠকের কথা নিশ্চিত করেছিলেন। বাঙ্গালী এবং বিদেশী কূটনৈতিক সুত্রগুলো এখন এটা স্বীকার করে নিয়েছে যে, মোশতাক এবং তাঁর রাজনৈতিক বন্ধুরা মুজিবের হত্যার অন্তত এক বছর আগে থেকে এই পরিকল্পনার সাথে যুক্ত ছিলেন। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সিনিয়র কর্মকর্তা এবং ওয়াকিবহাল বাঙ্গালী সুত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, যে, মুজিবের বিরুদ্ধে চালানো অভ্যুত্থান সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব ধারণা ছিল। মুজিবের মৃত্যুর প্রায় ছয় মাস আগে থেকেই মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের সাথে একাধিক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন।
মার্কিন দূতাবাসের শীর্ষ পর্যায়ের কূটনীতিকের ভাষ্যমতে, যারা মুজিবকে অপসারণে তৎপর ছিলেন মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা তাদের সাথে যোগাযোগ রাখছিলেন।
মার্কিন দূতাবাসের এই সূত্রমতে জানা যায় যে নভেম্বর ১৯৭৪ থেকে জানুয়ারী ১৯৭৫ এর মধ্যে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সাথে অনেকগুলো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল যার উদ্দেশ্য ছিল- বাংলাদেশে কোন ধরণের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ব্যাপারে মার্কিন সরকারের প্রতিক্রিয়া কি হবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, যদি প্রকৃত পক্ষেই কোন অভ্যুত্থান ঘটে যায়।
বৈঠকগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছিল এমন এক সময়ে যখন ওয়াশিংটনে ‘চার্চ এন্ড পাইক কংগ্রেশনাল কমিটি’ সিআইএ কর্তৃক সংঘটিত বিশ্বনেতাদের গুপ্তহত্যার বিষয়ে শুনানির জোরদার ব্যবস্থা নিচ্ছিল। এই কমিটির নিজস্ব অনুসন্ধানের প্রভাবে মার্কিন কূটনৈতিক মহল এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছিল এবং উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছিল। এমনকি মার্কিন সংবাদ মাধ্যমগুলো প্রকাশ্যে উর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বিচার দাবী করছিল, চিলি এবং অন্যান্য রাষ্ট্রে তাঁদের অনৈতিক হস্তক্ষেপের জন্যে।
এই অবস্থায়, ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস ’৭৫ এর জানুয়ারীতে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার ভাষ্যমতে- “আমরা এই ব্যাপারে একমত হলাম যে, আমাদের এই অভ্যুত্থান থেকে দূরে থাকা উচিত এবং ঐ সকল ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিত যারা এই অভ্যুত্থানে জড়িত রয়েছে।” যদিও দূতাবাসের উচ্চপর্যায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মুজিব-বিরোধী গ্রুপের সাথে সকল প্রকার সম্পর্কের অবসান ঘটানো হবে। কিন্তু পরবর্তীকালে মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যেই এব্যাপারে বিতর্কের সূচনা হয়।
দূতাবাসের যারা আগের বৈঠকগুলো সম্পর্কে জানত, তারা ১৯৭৫ এর গোড়ার দিকের ঘটনাবলী ছাড়া আর কিছুই তাদের ব্যক্তিগতভাবে জানা ছিল না বলে জানায়। অন্যান্যরা অভিযোগ করে যে, “যারা নিষ্কলুষ থাকতে চায় এমন কূটনীতিবিদ পর্যায়ে যোগাযোগ ছিন্ন হলেও, পরে মার্কিন দূতাবাসের সিআইএ-র প্রধান ফিলিপ চেরী এবং অন্যান্য এজেন্টদের মাধ্যমে যোগযোগ সঠিকভাবে রক্ষিত হচ্ছিলো।”
সাক্ষাতকারে ফিলীপ চেরী তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেছিলেন। “বাংলাদেশীরা নিজেরাই তা করছিল,” চেরী বলেন। তিনি আরও বলেন “এটা ধারণা করা বোকামি যে সকল অভ্যুত্থানের পেছনেই বিদেশী সরকারের হাত থাকে। বেশীরভাগ সময়েই দেখা যায় যে, অভ্যুত্থানের পেছনে দেশী লোকেরাই বেশি সক্রিয় থাকে।” যখন তাঁকে মোশতাকের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যোগসাজস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয় তখন তিনি বলেন, “ কিছু রাজনীতিবিদ থাকেন যারা প্রায়ই দূতাবাসে যাতায়াত করে থাকেন, এমনকি যোগাযোগও রাখেন। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে, অভ্যুত্থানের ব্যাপারে কোন দূতাবাস জড়িত থাকতে পারে।”
প্রকৃতপক্ষে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যা চিন্তা করতে বাধ্য করেছিল যে খন্দকার মোশতাকের সাথে দূতাবাসের সম্ভবত যোগাযোগ ছিল। বহুদিন ধরেই পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধকালীন ঘটনার সাথে সাথে, ১৯৭১ সালে তাঁর সাথে মার্কিনিদের গোপন যোগাযোগ এবং আপোষের একটি গল্প বা গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে এই ব্যাপারে কোন সঠিক ও নির্ভুল তথ্য বা প্রমাণাদি পাওয়া যায় না যা এই বিষয়টির অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারে। এখন পর্যন্ত, ওয়াশিংটনভিত্তিক কার্নেজি এন্ডোমেন্ট আন্তর্জাতিক শান্তি সংস্থা যা মার্কিন নীতি পর্যালোচনাকারী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপরিচিত, তাদের একটি অপ্রকাশিত গবেষণাপত্রে এ সংক্রান্ত এমন কিছু তথ্য দিয়েছে যা খন্দকার মোশতাকের সাথে মার্কিনিদের সম্পর্কের বিষয়টিকে একটি শক্ত ভিত্তি দিয়েছে। (চলবে)
No comments:
Post a Comment